অবরোধ-হরতাল কর্মসূচিতে দুর্দশায় শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ। এমন কর্মসূচি চলতে থাকলে নিম্ন আয়ের মানুষদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। জনজীবন বিপন্ন করে, এমন কর্মসূচি থেকে সরে আসার কথা জানান ভুক্তভোগীরা। রাজধানীর বিভিন্ন পেশার নিম্ন আয়ের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দিন আনে দিন খায় কিংবা স্বল্প আয়ে মাস চলা মানুষগুলোর যেন আর চলছে না; সে কথা তারা মুখ ফুটে বলতেও পারছে না। সামাজিকতা রক্ষায় অনেকটা লুকোচুরি করে চলতে হচ্ছে। ব্যয় কমাতে কেউ-বা তাদের সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে; কেউ-বা পরিবারের একাধিক সদস্যকে রোজগারের কাজে লাগিয়েছেন।
শ্যামলীতে কথা হয়, সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক রিয়াজুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাস্তায় কোনো যাত্রী নেই। মানুষ আতঙ্কে ঘর থেকে বের হয় না। আর বের হলেও তারা সিএনজিতে উঠতে চায় না। হয়তো রিকশায় ওঠে। তিনি বলেন, ‘আগে জমা ছিল ৮০০ টাকা, হরতাল অবরোধে সেই জমা কমে ৪০০ টাকা করেছে মহাজন। কিন্তু সেই টাকা তুলতেই মাথার ঘাম ছুটে যায়। খালি গাড়ি নিয়া ঘুরছি, কোনো যাত্রী পাচ্ছি না। আগে ৮০০ টাকা জমা করেও ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা নিয়া বাড়ি গেছি। আর এখন জমা ৪০০ টাকা দিয়া কোনদিন ৪০০, কোনোদিন ৬০০ টাকা বাড়ি নিয়ে যাই। এই ট্যাকায় কিছুই হয় না, জিনিসপত্রের যে দাম বেড়েছে, বাজারে গেলে মাথা ঘোরে। গরিব মানুষের কথা রাজনৈতিক দলের নেতারা ভাবেন না। ভাবলে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিত না।’
এদিকে, নরসিংদী বাজারে ভাতের দোকান করতেন মোশারফ মিয়া। পাঁচ সদস্যের সংসার। করোনাকালে সেই ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে পাড়ি জমিয়েছিলেন ২০২১ সালে ঢাকা শহরে। মোশারফ মিয়া রিকশা চালান আর তার স্ত্রী বাসাবাড়িতে কাজ করেন। এভাবে দুই জনের রোজগারে ভালোই চলছিল সংসার। মোশারফ বলেন, ‘অভাবী মানুষের কপালে ভালো থাকা আর নেই। করোনার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই জিনিসপত্রের চড়া দাম, এর মধ্যে যোগ হলো অবরোধ-হরতাল। রাস্তায় যাত্রী নেই। মানুষ খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হয় না, আমরা ভাড়া পাব কই?’ তার মধ্যে করোনাকাল থেকে গ্রামের অনেক অভাবী মানুষ শহরে এসেছে, উপার্জনের আশায়। তাদের বেশির ভাগই রিকশা চালায়। সে কারণে এখন যাত্রীর চেয়ে রিকশা বেশি। একজন যাত্রী রাস্তায় নামলে অনেক রিকশাওয়ালা সামনে এসে হাজির হয়। আগে ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা রোজগার হতো। এখন সেখানে ৫০০-৬০০ টাকা সারা দিনে আয় হয় না।
প্রাইভেট গাড়ির চালক সোহরাব আলী বলেন, ‘আগে বউ দুই বাচ্চা নিয়া ঘর ভাড়া করে থাকতাম, নিজে যা আয় করতাম, তাই দিয়াই সংসার চলত। এখন আর পারছি না। পাঁচ বছর ও আড়াই বছরের দুই মেয়েকে গ্রামে তার নানির কাছে রাইখ্যা আইচি। আর আমার বউকে বাসাবাড়ির কাজে দিয়েছি। দুই জনে মিলে যে টাকা মাসে আয় হয়, তা বাড়িতে বাচ্চাদের খাবারের জন্য পাঠাই আর আমরা এখানে কোনোরকমে খাইয়া চলি।’
রাজধানীর ফ্ল্যাট বাসায় বুয়ার কাজ করছে ছয় মাস আগে বিয়ে হওয়া দশম শ্রেণির ছাত্রী রেশমা। স্বামী একটি দোকানে কম্পিউটার অপারেটরের কাজ করেন। বিয়ের পর স্বামীর টাকায় ঘরভাড়া-খাওয়া চললেও, এখন জিনিসপত্রের যে দাম বেড়েছে, তাতে আর চলছে না। সকালে এক বেলা খেয়ে সারা দিন কাটিয়ে দেয় রেশমা। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মনিটরিং সেলের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে জীবনধারণের অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের দাম ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাই বেশি চাপে পড়েন। আর হঠাৎ কোনো ধরনের পরিবর্তনে মানসিক অসংগতি দেখা দেয় তাদের মধ্যেই। এর প্রভাব পড়ে জীবনযাপনের ওপর।’