ইরাকের রক্ষণশীল রাজনীতিবিদেরা দেশটির পারিবারিক আইন পারিবর্তন করতে চান৷ এর ফলে বাল্য বিবাহ বেড়ে যাওয়া ও নারী অধিকার কমার শঙ্কা তৈরি হয়েছে৷
গোটা মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে ইরাকের পারিবারিক আইনকে সবচেয়ে উদার বলে ধরে নেয়া হয়৷ তবে এই আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির সরকার৷ এ নিয়ে চলছে প্রতিবাদ, সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক৷
‘‘এটাই বাগদাদ,” সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী আলি আল মুকদাম ইরাকের রাজধানীতে হওয়া প্রতিবাদের ছবি দিয়ে সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ এমনটাই লিখেছেন৷ সপ্তাহান্তের এই প্রতিবাদে প্রায় ৫০০ মানুষ জড়ো হয়েছিলেন৷ তিনি আরো লিখেছেন, ‘‘ইরাকের রাজধানী কখনও কান্দাহার ছিল না, হবেও না৷” আফগানিস্তানে নারীদের অধিকার পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এই কথা বলেছেন তিনি৷
ইরাকের পার্সোনাল স্ট্যাটাস আইন বা পারিবারিক আইনের মাধ্যমে বিয়ে, বিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ত্ব ও উত্তরাধিকারের মতো ইস্যুগুলো নির্ধারিত হয়৷ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে এই বিষয়গুলোকে ধর্মীয়ভাবে সামলানো হলেও ইরাকে তা ১৯৫৯ সালে পাস হওয়া ১৮৮ নং আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হতো৷ সুন্নি ও শিয়া মুসলিম আদালতের পরিবর্তে সিভিল জুডিশিয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়৷
তবে বর্তমানে রক্ষণশীল শিয়া মুসলিম দলের সঙ্গে যুক্ত রাজনীতিবিদেরা এর পরিবর্তন ঘটাতে চান৷ ৪ আগস্ট তাদের আনা এই আইনের সংস্কার পার্লামেন্টে পেশ করা হয়েছে৷ এর প্রতিবাদে দেশটির মানধিকারকর্মী ও রাজনীতিবিদেরা ‘জোট ১৮৮’ গঠন করেছে৷ তারাই সপ্তাহান্তের বিক্ষোভের আয়োজন করেছে৷
বিক্ষোভে অংশ নেয়া স্থানীয় এক ব্যক্তি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘আমাদের যে আইন এখন রয়েছে তা ভালোর জন্য পরিবর্তিত হতে পারে, খারাপ কিছুর জন্য নয়৷ আমরা পেছনের দিকে যেতে পারি না৷” রাশা নামের ৫৩ বছরের ঐ ব্যক্তি নিপীড়নের ভয়ে তার পুরো নাম প্রকাশ করতে চাননি৷
ইরাকের শহর নাজাফে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়৷ রাশা বলেন, ‘‘আমার মতে তারা নারী অধিকারকে ঘৃণা করে, আর এ কারণেই তারা আইনের পরিবর্তন চায়৷”
কী পরিবর্তন
নতুন আইন অনুযায়ী ব্যক্তির বিয়ে সিভিল আদালত নাকি ধর্মীয় আদালতে নিবন্ধিত হবে তা বেছে নিতে পারবেন দম্পতিরা৷
যারা পরিবর্তনের পক্ষে তাদের দাবি ইরাকে বিয়ে মূলত ধর্মীয়ভাবেই হয়৷ তা আইন মোতাবেক না হলেও সামাজিকভাবে ন্যয়সঙ্গত বলেই বিবেচিত হয়৷ তাদের দাবি আইনের সংস্কারটি এই বাস্তবতার নিরিখেই করা হচ্ছে৷
কিন্তু বিরোধীদের দাবি আইনি ব্যবস্থা বেছে নেয়ার মধ্য দিয়ে ইসলামিক আইনের ক্ষতিকর ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি হবে৷ যেমন, বর্তমান আইনে বিয়ের আইনি বয়স ১৮ হলেও ধর্ম অনুসারে নয় বছরের শিশুকেও বিয়ে দেয়া যেতে পারে৷
জাতিসংঘের হিসাবে, এরই মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ের হার এক তৃতীয়াংশ৷ মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, ধর্মীয় নেতাদের মাধ্যমে অনিবন্ধিত বিয়ের কারণে শিশুদের বিয়ে এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না৷
আইনের পরিবর্তন হলে নারী অধিকারের দিক থেকে দেশটি পিছিয়ে পড়বে বলেও মনে করেন বিরোধীরা৷ এর ফলে ইরাকের সমাজ আরো বিভক্ত হয়ে পড়বে বলেও তাদের আশঙ্কা৷ বর্তমান আইনটি সব ইরাকির উপর সমানভাবে প্রযোজ্য৷ কিন্তু সংশোধনীটি পাস হলে সমাজে সংঘাত তৈরি হবে এবং ইরাকের আইনি ব্যবস্থাও এতে ভেঙে পড়বে বলে মনে করেন তারা৷
ইরাকের পারিবারি আইন এর আগেও পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল৷ ২০০৩, ২০০৫, ২০১৪ ও ২০১৭ সালে তা ব্যর্থ হয়েছে৷ তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সংসদের বিরোধী দলগুলির মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে এবার তা পাস হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে৷
শেষবার যখন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তখন সুন্নি রাজনীতিকেরা আইন পরিবর্তনের বিরোধিতা করেছিলেন৷ বর্তমানে পৃথক আরেকটি বিল পাসের প্রস্তাব রয়েছে তাদের, যার মাধ্যমে চরমপন্থী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস গ্রুপের সাবেক সদস্যদের ক্ষমা করার সুযোগ তৈরি হবে৷ এর আগে শিয়া মুসলিম রাজনীতিকেরা এর বিরোধিতা করেছিল৷ তারা উভয়ই এখন একে অপরের আনা বিল সমর্থন করার সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে৷
ব্রিটিশ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউসের ইরাক ইনিশিয়েটিভের প্রকল্প পরিচালক রেনাদ মনসুর বলেন, “অতীতে জ্যেষ্ঠ নেতারা এটিকে পর্দার আড়ালে ঠেলে দিতে পেরেছেন৷ এখন এটি পাস হবে কিনা তা বলা কঠিন, তবে তা আগের চেয়ে পাসের অনেক কাছাকাছি রয়েছে৷”