একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “বাঁচব না কি মরব এর কোনো গ্যারান্টি নাই, আপনি আছেন দল নিয়ে।”
সরকার পতনের পর থেকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এক অর্থে উধাও হয়ে গেছেন। আত্মগোপনে থেকে সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, “আগে বাঁচা মরা, পরে রাজনীতি।”
এ যেন আকাশ থেকে মাটিতে পতন! অথচ দুই মাস আগেও রাজনীতিতে ছিল দলটির ছিল একচেটিয়া দাপট।
এখন রাজপথে পুলিশ নেই, তবু একদল কিশোর-তরুণ ও যুবকের বাধায় ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেতে পারলেন না কেউ।
প্রবল গণ আন্দোলনে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে চলে যাওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের উদ্যোগ, সদ্য সাবেক হয়ে যাওয়া মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের রিমান্ডে নেওয়া, আদালতে আইনজীবী পর্যন্ত নিয়োগ করতে না পারা, এমন সব ঘটনা এখন ঘটছে।
টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে ৩৬ দিনের এক আন্দোলনে পতন ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের। সব মিলিয়ে বিপর্যয়ে পড়ে গেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা দলটি।
প্রথমবারের মত আন্দোলন মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হওয়া দলটির আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ নেতারা তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে কোনো দিক নির্দেশনাও পাঠাননি দুই সপ্তাহে।
ব্যাংকগুলোর নগদ টাকার সংকট কাটছে না কেন?
বেপরোয়া হামলার মুখে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, নেতাকর্মীরা পলাতক, একসঙ্গে বসার মত কার্যালয়ও নেই বললেই চলে, প্রায় সবগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও ছিন্ন বিচ্ছিন্ন, পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরেও গোপালগঞ্জ ছাড়া তারা রাজপথে সেভাবে সক্রিয় হতে পারছেন না কোথাও।
একজন পুরনো রাজনীতিবিদ বলেছেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরও বিরুদ্ধ পরিবেশে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম আর রাজপথের তৎপরতা এভাবে পুরোপুরি থমকে দাঁড়ায়নি।
এই আওয়ামী লীগ নেতা দেশেই আছেন, কিন্তু নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
একের পর এক মামলা
গত ১৪ অগাস্ট আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জুলাইয়ে সংঘাতে মৃত্যুর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার কথা বলেন।
সেদিনই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন জমা পড়ে এবং সেই আবেদন প্রসিকিউশন শাখা গ্রহণও করে।
শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের যে উদ্যোগ নেন, সে সময় এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
এই ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর চূড়ান্ত বিচার শেষে একাত্তরের খুনি বাহিনী আলবদর ও পরে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে থাকা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
দল হিসেবেও জামায়াতের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আইনে সংগঠনের সাজা সুনির্দিষ্ট না থাকায় সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি, আওয়ামী লীগ সরকার আইন সংশোধনে আশ্বাস দিয়েও আর উদ্যোগ নেয়নি।
স্পষ্টত সরকার পতন আন্দোলনের সময় মৃত্যুকে অন্তর্বর্তী সরকার ‘গণহত্যা’ হিসেবে দেখাতে চাইছে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা কেবল না, ‘গণহত্যার’ দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যে ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার গঠন করেছিল মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে করতে।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা কেবল না, ‘গণহত্যার’ দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যে ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার গঠন করেছিল মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে করতে।
ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করার আগেরদিন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মত হত্যা মামলা হয়। কোটা আন্দোলন চলার মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে এক দোকান মালিকের মৃত্যুর ঘটনায় এই মামলা গ্রহণ করে তদন্তের আদেশও এসেছে।
এরপর ঢাকায় একাধিক, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, নাটোর, জয়পুরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় হত্যার মামলা হয়। ঢাকায় হয়েছে একটি অপহরণ মামলাও।
এসব মামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগ থেকে কোনো বক্তব্য আসছে না, ১৪ অগাস্ট সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাধ্যমে শেখ হাসিনা একটি বিবৃতি দিলেও এসব মামলা নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার।
ক্ষমতাচ্যুত দলটির সেই সাংগঠনিক সম্পাদক অবশ্য এসব মামলাকে পাত্তা দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, “নেত্রী এরশাদ আমলে জেল খেটেছেন, ১/১১ তেও জেল খেটেছেন। মামলা, হামলা করে আওয়ামী লীগকে দমিয়ে রাখা যাবে না। নেত্রী জামায়াতের বিচার করেছেন, এখন সুযোগ বুঝে তার প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। তবে সময় মত নেতাকর্মীরা ঘুরে দাঁড়াবে, সব ষড়যন্ত্র রুখে দেবে।”
কিন্তু এই মুহূর্তে দলের কোনো তৎপরতা নেই কেন- এই প্রশ্নে আত্মগোপনে থাকা সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নেত্রী আমাদের কোনো দিক নির্দেশনা দিয়ে যাননি, করণীয় কিছু বলেননি।”
দলের দায়িত্ব কে পালন করবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “কোনো নির্দেশনা নেই।”
ছিন্নভিন্ন দল
সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেওয়ার দ্বিতীয় দিনে গত ৫ অগাস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাকে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব ছেড়ে দেশ ত্যাগ করতে ৪৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল। তিনি জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগ পাননি।
সেদিন সরকার পতনের দাবিতে ‘মার্চ ফর ঢাকা’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল কোটা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আগের রাতে কারফিউ জারি করা হয়।
পরদিন সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হতে দেয়নি পুলিশ। যাত্রাবাড়ী থেকে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তবে উত্তরায় মানুষের জমায়েত হয়। এর মধ্যে বার্তা আসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দুপুরে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, তখনই ইঙ্গিত আসে, সরকারের পতন হয়ে গেছে।
সেনাপ্রধান বিকাল পৌনে ৪টায় এসে জানান, প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা, দেশ পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হবে।
এর মধ্যেই আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, দলের নেতাকর্মী এমনকি সমর্থকদের বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নি সংযোগ শুরু হয়ে যায়।
একের পর এক দেশ ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে কেন?
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেও চলে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ।
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটিতেও চলে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ।
এই গণ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ আওয়ামী লীগকে ‘বহু বছর পিছিয়ে দিয়েছে’ বলেও মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা।
দলীয় সভাপতিতে ‘ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করার প্রতিবাদে’ সোচ্চার কেবল গোপালগঞ্জ। সেখানে বড় বড় জমায়েত হচ্ছে। এর বাইরে আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত কিছু এলাকায় মিছিলের খবর এসেছে।
৩৬ দিনের এক আন্দোলনে সাড়ে ১৫ বছরের দাপুটে শাসনের অবসানের পর শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় টানা কয়েকদিন কথা বলেছেন। কিন্তু একেকদিন তার একেক ধরনের বক্তব্যে কর্মীদের বিভ্রান্তি আরো বেড়েছে।
শেখ হাসিনা ভারতে যাওয়ার পর বিবিসিকে জয় বলেন, তার মা আর রাজনীতিতে আসছেন না।
সেদিন তিনি বলেন, “আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে তিনবার ক্যু হল, সব কিছু হারিয়ে বিদেশে থাকতে হল। আাদের মা বাদে আমরা সবাই তো অনেকদিন ধরে বিদেশে আছি। এখানে আমরা সেটেলড, অভ্যস্ত। আমাদের এখাকার জীবনে কোনো অসুবিধা নাই। আমরা এখানে থাকতে অভ্যস্ত।”
হামলার মুখে সারা দেশেই পালিয়ে বেড়ানো নেতাকর্মীরা জয়ের এই বক্তব্যে আরও হতাশ হয়ে পড়েন।
পরে অবশ্য জয় বলেছেন, তিনি রাজনীতিতে আসতে এবং দলের নেতৃত্ব নিতে প্রস্তুত, নির্বাচন দিলেই শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন, তিনি ভারত যাওয়ার আগে পদত্যাগ করেননি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিবস্ত্র ১৫ আগস্ট ও দিশেহারা আওয়ামী লীগ কর্মীরা
তারা কেউই রাজনীতিতে ফিরতে পারেননি
আশ্রয় প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখবে জার্মানি
ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদে অভূতপূর্ব কর্মবিরতি