ঠিক দশ বছর তিন মাস আগে নরেন্দ্র মোদী যখন প্রথমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন, তখন প্রতিবেশী সবগুলো দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের দিল্লিতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিরাট একটা চমক দিয়েছিলেন তিনি। এমন কী ‘দাওয়াত’ পেয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফও। মোদী সরকার সেই প্রথম দিন থেকেই বরাবর বলে এসেছে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে প্রতিবেশীরা।
এই নীতিটারই পোশাকি নামকরণ করা হয়েছে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ বা ‘প্রতিবেশীরা সবার আগে’ – এবং দিল্লিতে সরকারের মন্ত্রী বা নীতি-নির্ধারকরা গত এক দশকে বারবার বলে এসেছেন, নরেন্দ্র মোদীর পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ এটাই!
অন্যভাবে বললে, ভৌগোলিকভাবে যারা ভারতের চেয়ে দূরে (সে আমেরিকাই হোক বা নাইজেরিয়া) তাদের চেয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ঘরের কাছের পড়শিদের (শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, নেপাল প্রভৃতি) সঙ্গে সম্পর্ককে ভারত বেশি গুরুত্ব দেবে এবং তাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে – এটাই হল ‘নেইবারহুড ফার্স্টে’র সার কথা।
তবে মুখের কথা একটা জিনিস, বাস্তবেও যে সব সময় মোদী সরকারের কাজে তার প্রতিফলন দেখা গেছে তা কিন্তু নয়। পশ্চিমের বন্ধুরা যেমন অনেক সময়ই দিল্লির কাছে দৃশ্যত বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, দিল্লিকে অনেক বেশি মাথা ঘামাতে হয়েছে চীনকে নিয়েও।
আবার নরেন্দ্র মোদী নিজে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম সফরে নেপাল (অগাস্ট ২০১৪), শ্রীলঙ্কা (মার্চ ২০১৫) বা এমন কী বাংলাদেশেও (জুন ২০১৫) যে বিপুল অভ্যর্থনা ও মানুষের বিরাট সাড়া পেয়েছিলেন, পরে সে সব দেশে ছবিটা কিন্তু আর তত বন্ধুত্বপূর্ণ থাকেনি। উন্নতির কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও।
আর এখন ‘নেইবারহুড ফার্স্টে’র এক দশক পরে এসে দেখা যাচ্ছে, যে শ্রীলঙ্কাকে চরম আর্থিক সঙ্কটের সময় ভারত অনেক সাহায্য করেছে সে দেশের সরকারও দিল্লির ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে চীনা গোয়েন্দা জাহাজকে তাদের বন্দরে ভিড়তে দিচ্ছে।
নেপালে নতুন সংবিধান প্রণয়নের সময় ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে যে ‘অর্থনৈতিক অবরোধ’ কর্মসূচি পালিত হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে সে দেশের সাধারণ মানুষ ভারত-বিরোধী প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন। নেপালের ক্ষমতাতেও আছেন কে পি শর্মা ওলি, যিনি কট্টর ভারত-বিরোধী বলেই পরিচিত।
মালদ্বীপেও গত বছর ভারত-পন্থী একটি সরকারকে হঠিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন মোহামেদ মুইজ, যিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরই তার দেশ থেকে সব ভারতীয় সেনা সদস্যকে সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তার দলের ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন মালদ্বীপে ভাল সাড়া ফেলেছে, প্রেসিডেন্ট মুইজ চীনের দিকে ঝুঁকছেন কোনও রাখঢাক না-করেই।
এমন কী, যে ভুটান সামরিক, বৈদেশিক বা অর্থনৈতিক – প্রায় সব ক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভরশীল, তারাও চীনের সঙ্গে আলাদাভাবে সীমান্ত আলোচনা শুরু করেছে, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে চীনের প্রস্তাবকেও সরাসরি নাকচ করে দেয়নি।
আফগানিস্তান ও মিয়ানমারে যে দুটো সরকার এখন ক্ষমতায়, তাদের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক ভাল এ কথা বলা চলে না কোনও মতেই।
তালেবানের সঙ্গে যেমন ভারতের এখনও পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্কই স্থাপিত হয়নি, আর এই দুটো দেশেই বিভিন্ন খাতে ভারতের শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ এখন প্রবল অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
এই তালিকায় সবশেষ সংযোজন বাংলাদেশ – যেখানে বিগত দেড় দশক ধরে ভারতের একটি ঘনিষ্ঠ বন্ধু সরকার ক্ষমতায় থাকার পর প্রায় রাতারাতি সেই সরকার বিদায় নিয়েছে। তারপর এমন কিছু শক্তি ক্ষমতার বৃত্তে চলে এসেছে যারা ঠিক ভারতের মিত্র হিসেবে পরিচিত নন।
তা ছাড়া সাড়ে তিন বছর আগে নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সময়ই তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও সহিংসতা তুঙ্গে উঠেছিল। সে দেশে সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনেও যে একটা প্রবল ভারত-বিরোধী চেহারা ছিল তা পর্যবেক্ষকরা প্রায় সকলেই মানেন।